জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন

জাতিসংঘ সদরদপ্তরে টানা ৬ষ্ঠ বারের মতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের এ আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এবারেও জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সাথে যৌথ অংশীদারিত্বে ইভেন্টটির আয়োজন করে এলসালভাদর, নাইজেরিয়া, পর্তুগাল ও শ্লোভাকিয়া মিশন। এতে সহ-অংশীদারিত্ব করে জাতিসংঘ সচিবালয় ও ইউনেস্কো। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি। এছাড়া অনুষ্ঠানটি উপলক্ষে শুভেচ্ছাবাণী প্রদান করেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ও নিউইয়র্ক সিটির মেয়র।

অনুষ্ঠানে বক্তাগণ যাতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখতে পারেন সেজন্য এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ছয়টি অফিশিয়াল ভাষায় গোটা অনুষ্ঠানটি অনুবাদের সুব্যবস্থা রাখা হয়। বাংলাদেশের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন এর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের থিম সঙ্গীত-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি..’ একাধিক ভাষায় উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে মরক্কো, এলসালভেদর, শ্লোভাকিয়া ও পর্তুগালের সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও ছিল মনোমুগ্ধকর। এছাড়া জাতিসংঘ সচিবালয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সভাপতির কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাগণের স্ব স্ব ভাষায় রেকর্ডকৃত বহুভাষিক ভিডিও বার্তা পরিবেশন করা হয় অনুষ্ঠানটিতে। জাতিসংঘ ওয়েব টিভিতে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

উদ্বোধনী বক্তব্যে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদগণ এবং ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই জাতির পিতার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম যার চুড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মাধ্যমে।  মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মার্তভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশীদের উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে ইউনেস্কোর মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর পূর্ণ স্বীকৃতি আদায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা স্মরণ করেন রাষ্ট্রদূত ফাতিমা। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও অবদানের কথাও স্মরণ করেন তিনি। কোভিডের ভয়াবহ প্রভাবের কথা উল্লেখ করে এবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য -‘প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বহুভাষায় জ্ঞানার্জন: সঙ্কট এবং সম্ভাবনা’ বেছে নেওয়ার জন্য ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি বলেন, “প্রযুক্তি বহুভাষিক শিক্ষার অগ্রগতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সকল ভাষার প্রাণশক্তি ফিরে পেতে আমাদের সকল অংশীজনকে একসাথে কাজ করতে হবে; কম খরচে ব্যবহার-বান্ধব প্রযুক্তির বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে যা বহুভাষিক শিক্ষাকে সর্বত্র এগিয়ে নিতে পারে”।

স্প্যানিশ ভাষাভাষী ফ্রেন্ডস্ গ্রুপের সভাপতি হিসেবে জাতিসংঘে নিযুক্ত কোস্টারিকার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ভাষা বিষয়ক এনজিও কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

সাধারণ পরিষদের সভাপতিসহ অন্যান্য বক্তাগণ জাতিসংঘে বহুভাষাবাদ ও মাতৃভাষার প্রচারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রযুক্তির সম্ভাবনাময় ভূমিকা এবং প্রযুক্তিগত বিভাজন দূর করার কথা তুলে ধরেন তারা। নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে গিয়ে বক্তাগণ বিলুপ্তির পথে থাকা ভাষার সংরক্ষণের গুরুত্বও তুলে ধরেন।

জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের আগে, সকালে, যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের আয়োজন করা হয়। নিউইয়র্ক সফররত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী জনাব মো: তাজুল ইসলাম এমপি এবং একই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব হেলালুদ্দীন আহমদ এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মন্ত্রীর নেতৃত্বে সিনিয়র সচিব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং উপস্থিত মিশনের কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর সফরসঙ্গীগণ মিশনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন।

অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ মিশনকে ধন্যবাদ জানান মন্ত্রী। তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, মাতৃভাষার গুরুত্ব, মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তিমূলক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও অদম্য অগ্রযাত্রার কথা তুলে ধরেন। মিশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আরও নিবেদিত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ এবং মহান একুশের ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।


by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *