একাত্তরের ডিসেম্বর: স্মৃতিতে ভাস্বর
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নায়েরগাঁ যখন পৌঁছালাম বিকেল পেরিয়ে তখন সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। এবার যেতে হবে পায়ে হেঁটে সাত মাইল পথ পারি দিয়ে সিরাজ মামার বাড়িতে। আমাদের সহযাত্রী দূর সম্পর্কের এই মামা ঢাকার পাশের কোন এক থানায় Thana Education Officer হিসেবে কাজ করছিলেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকায় আমাদের সাথেই থাকতেন।
শিবপুর গ্রামে সিরাজ মামার বাড়িতে রাত ন’টায় পৌঁছালাম। অজপারাগাঁয়ে শীতের সময়ে রাত ন’টা মানে অনেক রাত। বাড়ির লোকজন এতোরাতে আমাদের দেখে হতবাক। সহসাই বিস্ময়ের ভাব কাটিয়ে তার লেগে পড়লেন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে। খাওয়া শেষ হতে রাত এগারোটা বেজে গেলো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমরা পথিককুল বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর জানা হলো না।
প্রাতরাশের আয়োজন ছিল বেশ ভালোই। খেলামও পেটপুরে। কারণ কখন বাড়ি পৌঁছাবো কে জানে। সকাল ন’টায় রওয়ানা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। এবার সহযাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা পাশের গ্রামের ফজলু মামা।
মাঠের ধান কাটা শেষ হয়েছে। আমরা হেঁটে চলেছি নাড়ার ওপর দিয়ে। শীতের রোদে হাঁটতে ভালোই লাগছে। ১২/১৪ মাইল পথ পারি দিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম পড়ন্ত বিকেলে। কেমন করে দূর্গম পথ পারি দিয়ে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছালাম সে গল্প আম্মা ও ছোট ভাইকে জানালে তারা বিস্ময় প্রকাশ করলেন। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষে দু’ভাই বসে পড়লাম ট্র্যানজিস্টার নিয়ে। যুদ্ধের হাল নাগাদ খবর যে জানতে হবে।
আঁশেপাশের দু’চার বাড়ির মধ্যে ট্র্যানজিস্টার ছিল না। স্বাভবতই সন্ধ্যার পর আমাদের ঘরে বেশ ভালোই ভিড় জমে যেতো।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর ছাড়াও অন্যতম আকর্ষণ ছিল “চরমপত্র”। ব্যাঙ্গাত্মক ও শ্লেষাত্মক শব্দচয়নে এম আর আক্তার মুকুল কতৃক রচিত ও পঠিত চরমপত্র শোনার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকতো।ঢাকায় স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনতাম অতি অনুচ্চ ভলিউমে আর বাড়িতে ফুল ভলিউমে।
প্রতিদিনই খবর পাচ্ছি মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযাদ্ধারা তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে ঢাকার দিকে। ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী অনেকগুলো জেলার পতন ঘটেছে। ঢাকার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। ইতিমধ্যে সকল স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যখন তখন কারফিউ জারী করা হচ্ছে। স্বভাবতই বুঝা যাচ্ছে ঢাকার পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আকাশ বানীর খবর থেকে জানা গেলো ভারতীয় সেনা প্রধান শ্যাম মনেকশ রক্তপাত এড়ানোর জন্য নিয়াজীকে আত্মসমর্পনের আহ্বান জানিয়েছেন।ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান থেকে ঢাকা শহরে ছড়ানো হচ্ছে আত্মসমর্পনের আহ্ববান সম্বলিত প্রচারপত্র।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সুমতি হলো, তারা আত্মসমর্পনে রাজি হলো। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন দলিল স্বাক্ষরিত হলো। বেতারে সে খবর শোনে নিভৃত পল্লীতে বসে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। আমি নই শুধু, আঁশে পাশের সকল মানুষও আনন্দে একে অপরকে আলিঙ্গন করতে থাকলো। এ যেনো ঈদ উৎসবের চেয়েও বড় কোনো উৎসব। অসাধারণ সে মুহূর্তের কথা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যি দূরহ। ২৫ শে মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যে চরমপত্রের সূচনা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর রাতে তার সমাপ্তি ঘটলো। অনেকের সাথে আমিও চরমপত্রের শেষ পর্বটি প্রাণভরে উপভোগ করেছিলাম।
এতোদিন অবরুদ্ধ ঢাকায় ছিলাম। এখন মুক্ত ঢাকায় যেতে প্রাণ আনচান করছে। দু’দিন পর বেতারে ঘোষনা এলো সরকারী কর্মকর্তাদের অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে হবে। ২০ ডিসেম্বর সকাল ন’টায় রওয়ানা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আহা, সে কী আবেগ উত্তেজনা। স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় যাচ্ছি নতুন সরকারের অধীনে কাজ করতে। সাথে আছেন আমার ফুফাতো ভাই নারায়নগন্জ মেরিন ডিজেল ট্রেনিং সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর নজরুল ভাই।
কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো রিক্সায়, কখনো-বা মুড়ির টিনের মতো বাসে করে নারায়নগন্জের কাইক্কারটেক নামের একটা জায়গায় যখন পৌঁছলাম রাত তখন ন’টা। ইতিমধ্যে বারো ঘন্টা পার হয়ে গেছে, শরীর আর চলে না, কোনো বাহনও পাওয়া যায় না, তাহলে উপায়? পাশেই দেখলাম একটা স্কুলে অনেক লোকের সমাগম। সেখানে গিয়ে জানলাম এরাও সবাই ঢাকার যাত্রী। রাতটি স্কুল ঘরেই কাটিয়ে দেবে। আমরাও তাই সিদ্ধান্ত নিলাম। আশেপাশের বাড়ি থেকে প্লেটে করে ভাত আলুভর্তা ডাল পরিবেশন করা হচ্ছে কিছু টাকার বিনিময়ে। তাই খেয়ে নিলাম, দিনভর অভুক্ত আমাদের কাছে মনে হয়েছিল এ যেনো অমৃত খেলাম। অতপর বেন্চিতে শুয়ে বসে রাত কাটিয়ে দিলাম। সত্যি কথা এ ছিল আজীবন মনে রাখার মতো বিরল এক অভিজ্ঞতা।
সকালে উঠে নারায়নগন্জ হয়ে ঢাকার পথে আবারো যাত্রা শুরু। নজরুল ভাই নারায়নগন্জ থেকে গেলেন। ভাগ্যক্রমে আমি ঢাকার একটা বাস পেয়ে গেলাম এবং তাতে চড়ে বেলা এগারোটায় গুলিস্তানে এসে নামলাম। মুক্ত ঢাকায় প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নেয়ার অসাধারণ এক অনুভূতি নিয়ে মতিঝিল কলোনীর দিকে রওয়ানা হলাম।
চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ি এদিক ওদিক টহল দিচ্ছে।দেখলাম সাধারণ পোষাকধারীদের কেউ কেউ অস্র হাতে নিয়ে যত্র তত্র ঘোরাঘুরি করছে। বুঝলাম এরা মুক্তিযাদ্ধা।
২২ তারিখ সকালে অফিসে গিয়ে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখতে পেলাম।আমরা যে বেঁচে আছি এ আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরছি। গত কয়েকদিনের কঠিন সময়গুলোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। কাজ কর্ম তেমন হলো না, দিনটি এভাবেই কেটে গেলো।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে আসবেন এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তারিখটি ছিল সম্ভবত ২৩ ডিসেম্বর। দক্ষিণের গেইট পেরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে সভার আয়োজন। অন্য অনেকের সাথে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর তেজোদীপ্ত ভাষণটি আমিও শুনেছিলাম। ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও অগ্রসরমান সপ্তম নৌবহরের বিষয় উল্লেখপূর্বক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা।
বিজয়ের পর স্বভাবতই শহরে কিছুটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা সর্বমহলে ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছিল। ইতিমধ্যে পাকিস্তানেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। ভূট্টো এখন ক্ষমতার মসনদে। সাধারণ মানুষের ধারণা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কিংবা আটকে রাখার সাহস ভুট্টোর হবে না। তবে কখন স্বাধীন দেশে পা রাখবেন বঙ্গবন্ধু? এমন প্রতীক্ষায় ডিসেম্বরের বাকি দিনগুলো কেটে গেলো। সমাপ্ত।
ঢাকা, ২৯,১২,২০২১
Leave a Reply